প্রফেসর ড. হারুন-অর-রশিদঃ-
মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী ন্যূনতম সময়ের মধ্যে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের পুনর্গঠন-পুনর্বাসন সম্পন্ন করে বঙ্গবন্ধু যে মুহূর্তে সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্রের একটি শক্তিশালী ভিত রচনা ও এর সার্বিক উন্নয়নে মনোনিবেশ করলেন, ঠিক তখনই মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত দেশি-বিদেশী চক্রের পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রে সংঘটিত হয় বাঙালি জাতির ইতিহাসে সবচেয়ে মর্মান্তিক, ১৫ই আগস্টের ট্র্যাজেডি। এরপর মোশতাক-জিয়া-এরশাদ-বেগম খালেদা জিয়া ও বিএনপি-জামাত জোট সরকারের আমলে এ দেশে মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যাখ্যাত সেই পাকিস্তানি সেনা-আমলা শাসন ও সাম্প্রদায়িক ধারার পুনঃপ্রত্যাবর্তন ঘটে। বাংলাদেশ পরিণত হয় ‘মিনি পাকিস্তানে’। হত্যা, ক্যু, পাল্টা ক্যু’র মাধ্যমে ক্ষমতা দখল বা দখলের চেষ্টা, ভোটাধিকারসহ জনগণের মৌলিক অধিকার হরণ, নির্বাচন ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙ্গে পড়া, নিষিদ্ধ থাকা ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িক দলের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার, সংবিধানের প্রস্তাবনাসহ চার রাষ্ট্রীয় মূলনীতিতে পরিবর্তন, বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনিদের বিচারের পরিবর্তে তাদের রক্ষায় জারি করা হয় কুখ্যাত ‘ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স’ (২৬শে সেপ্টেম্বর ১৯৭৫), তাদেরকে সরকারি আশ্রয়-প্রশ্রয়দান ও বাংলাদেশের বিদেশস্থ দূতাবাসে বিভিন্ন পদে আসীন করা, শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযম-কে পাকিস্তানি পাসপোর্টে বাংলাদেশে আসার অনুমতি, তাকে এ দেশে বসবাস ও রাজনীতি করার সুযোগ দান (১৯৭৮), সংবিধান সংশোধন করে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ঘোষণা (৭ই জুন ১৯৮৮), মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শাহ আজিজুর রহমানকে প্রধানমন্ত্রী করা, দুই যুদ্ধাপরাধী নিজামী ও মুজাহিদকে মন্ত্রী বানিয়ে (২০০১-২০০৬) মুক্তিযোদ্ধাদের রক্তস্নাত বাংলাদেশের পতাকা তাদের হাতে তুলে দেয়া, ৭১-এর ঘাতক-খুনি ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরোধিতা, অনেক সংগ্রামের বিনিময়ে অর্জিত নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার ওপর দলীয় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার হীন চেষ্টায় চতুর্দশ সংশোধনী (১৬ই মে ২০০৪)-র মাধ্যমে এর মূল উদ্দেশ্য নস্যাৎ, ধর্মের নামাবলি পরিহিত উগ্র সন্ত্রাসী বা জঙ্গিগোষ্ঠীর প্রতি পৃষ্ঠপোষকতা দান ইত্যাদি এদের শাসন আমলের বৈশিষ্ট্য।
১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যা বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতির জন্য যেমনি, তেমনি রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের জন্য ছিল এক মহাবিপর্যয়কর ঘটনা। বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বদানে যারা সক্ষম ছিলেন, তাঁরা হলেন তাঁরই ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সহচর জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী এবং এ এইচ এম কামারুজ্জামান। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে হত্যার তিন মাসেরও কম সময়ের মধ্যে ১৯৭৫ সালের ৩রা নভেম্বর ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি অবস্থায় একই খুনিচক্র তাঁদেরও বর্বরোচিতভাবে হত্যা করে।
৭৫-পরবর্তী আওয়ামী লীগের পুনর্গঠন কিছুতেই সহজসাধ্য ছিল না। রাষ্ট্রীয় প্রচারমাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণ পর্যন্ত নিষিদ্ধ ছিল। ১৯৭৬ সালের ২৮শে জুলাই ‘রাজনৈতিক দলবিধি’ (পিপিআর) জারি করা হয়। বিচারপতি সায়েম তখন প্রেসিডেন্ট পদে অধিষ্ঠিত থাকলেও, সরকারের নিয়ন্ত্রণ ছিল জেনারেল জিয়ার হাতে। পিপিআর-এর আওতায় রাজনৈতিক দলের জন্য নিবন্ধন লাভ আবশ্যকীয় করা হয়। আওয়ামী লীগ প্রথম যে আবেদনপত্র জমা দেয়, তাতে খসড়া গঠনতন্ত্রে ‘বঙ্গবন্ধুর আদর্শ’ এ কথা উল্লেখ থাকায় তা অগ্রাহ্য হয়। নিবন্ধন লাভের স্বার্থে তা পরিবর্তন করে পুনরায় আবেদন করা হলে, ৪ঠা নভেম্বর ১৯৭৬ আওয়ামী লীগ দল হিসেবে সরকারের অনুমোদন পায়।১
এদিকে আওয়ামী লীগকে পুনর্গঠিত করার প্রক্রিয়ায় দলের অভ্যন্তরে দেখা দেয় নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব।
১৯৮১ সালের ১৪-১৬ই ফেব্রুয়ারি মতিঝিল ইডেন হোটেলে অনুষ্ঠেয় দলের কাউন্সিলকে সামনে রেখে তা এমনই চরমরূপ লাভ করে যে, আওয়ামী লীগের ভাঙ্গন নিশ্চিত বলে তখন অনেকেই মনে করেন।৩ পত্র-পত্রিকায় এই মর্মে শিরোনাম হয়। দলের এ-রকম এক সন্ধিক্ষণে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার আবির্ভাব ঘটে আওয়ামী লীগের ঐক্যের প্রতীক হিসেবে।৪ তখন দিল্লিতে তাঁর নির্বাসিত জীবন-যাপন। বয়স মাত্র ৩৩ বছর। তাঁর অনুপস্থিতিতেই দলের সর্বমহল বা পক্ষ সর্বসম্মতিক্রমে তাঁকে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী নির্বাচিত করেন।
বঙ্গবন্ধু হত্যার পর দীর্ঘ ৬ বছর নির্বাসিত জীবন যাপনে বাধ্য হয়ে অবশেষে ১৭ই মে ১৯৮১ আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হিসেবে শেখ হাসিনার প্রিয় স্বদেশে প্রত্যাবর্তন। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার, মানুষের ‘ভোট ও ভাতের’ অধিকার আদায় এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শ পুনঃপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে শুরু হয় তাঁর জীবনের এক সুদীর্ঘ সংগ্রাম। প্রধানত তাঁর নেতৃত্বেই এরশাদের দীর্ঘ সেনাশাসন (১৯৮২-১৯৯০)-এর অবসান ঘটে। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিও তাঁর আন্দোলনের কারণেই সেদিন সফলতা লাভ করে। ২১ বছর ধরে বিরোধী দলে অবস্থান আর জেল-জুলুম-নির্যাতন ভোগ শেষে ১৯৯৬ সালের ১২ই জুনের নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আওয়ামী লীগের সরকার গঠন ও ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন তাঁরই নেতৃত্বের সাফল্য। মুখ্যত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের (২০০১-২০০৬) জাতীয় স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থে তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে ভবিষ্যৎ নির্বাচনে তাদের পক্ষে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে গৃহীত বিশেষ পদক্ষেপ (সংবিধানের চতুর্দশ সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারপতিদের অবসরগ্রহণের বয়স ৬৫ থেকে ৬৭ বছরে বৃদ্ধি)৫ থেকে উদ্ভুত চরম সহিংস রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ১/১১-এর সৃষ্টি। এরপর সেনানিয়ন্ত্রিত তথাকথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে (২০০৭-২০০৮) সেনাশাসনকে দীর্ঘায়িত করার নীলনকশা অনুযায়ী নেপথ্যের সেনাকর্মকর্তাদের নিয়ে তথাকথিত সংস্কার কর্মসূচির নামে বড় রাজনৈতিক দলে ভাঙ্গন সৃষ্টি, দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের দুই নেত্রীকে রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে দেয়া বা ‘মাইনাস টু থিওরি’ ইত্যাদি উদ্যোগ বা ষড়যন্ত্র প্রধানত শেখ হাসিনার দৃঢ় ও সাহসী অবস্থানের কারণে নস্যাৎ হয়ে যায়। ফলে ২০০৮ সালের শেষের দিকে জাতীয় নির্বাচন দিতে নেপথ্য সেনাশাসকরা বাধ্য হয়।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এর সাইটে লিখাটি হুবহু এখানে তুলে ধরা হলো

Post a Comment